“ভেতরের তিন পৃথিবী: Dissociative Identity Disorder ও এক সাহসী তরুণীর গল্প”

- আপডেট সময় : ১১:২৭:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫ ৪৮ বার পড়া হয়েছে
ড. মো: মাহিদ শেখ ,সাইকোলজিস্ট ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ: আমাদের মানসিক জগৎ নানা সময়ে নানা রঙে রঙিন হয়। কিন্তু কখনো কখনো মানসিক আঘাত এতটাই গভীর হয়ে পড়ে যে, একজন মানুষের ভেতরে জন্ম নেয় একাধিক সত্তা—যাদের চিন্তা, ভাষা, আচরণ এবং স্মৃতি একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই জটিল কিন্তু বাস্তব মানসিক অবস্থার নাম Dissociative Identity Disorder (DID)। এই লেখায় আমরা জানবো “সাবিনা” নামের এক তরুণীর জীবনের গল্প, যিনি এই ব্যাধির সঙ্গে নিরব এক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সাবিনা (ছদ্মনাম), ২৬ বছর বয়সী একজন কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি রাজশাহীর একটি সাধারণ পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। শুরুতে তার আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা থাকলেও পরিবার তা গুরুত্ব দেয়নি। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয় তখন, যখন সাবিনা নিজেকে মাঝে মাঝে “রুহি” নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন—একটি ৮ বছরের ছোট মেয়ের রূপে। তার মা বলতেন, “ও কখনো ছোট মেয়ের মতো করে কাঁদে, আবার কখনো এমন রেগে যায় যে, ওকে চেনা যায় না। আমরা ভাবতাম, এটা বোধহয় ওর একটা দুষ্টুমি।”
সাবিনার স্মৃতিতে অসংখ্য ফাঁক ছিল। কখনো তিনি পরীক্ষায় গেছেন কিনা মনে করতে পারতেন না, আবার কখনো নিজেকে আবিষ্কার করতেন একেবারে অপরিচিত জায়গায়—যার কোনো স্মৃতিই তার মনে নেই। এমনকি তার কণ্ঠস্বর, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবহারও সময়ভেদে ভিন্ন হতো। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সাবিনার মধ্যে অন্তত তিনটি আলাদা সত্তা রয়েছে: সাবিনা (মূল সত্তা) — বাস্তবতাভিত্তিক ও শান্ত, রুহি — একটি ৮ বছরের ভয়পাওয়া শিশু, এবং মিতু — আত্মরক্ষামূলক, দৃঢ়চেতা এক নারী।
শৈশবেই সাবিনা দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের দ্বারা যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা এবং পরিবারের অবহেলা তার মানসিকতায় গভীর ক্ষত তৈরি করে। এই যন্ত্রণার ভার সহ্য করতে না পেরে তার মন নিজের প্রতিরক্ষার জন্য তৈরি করে ভিন্ন ভিন্ন ‘সত্তা’—যারা তার হয়ে সেই কষ্ট সহ্য করে।
পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাবিনাকে DID রোগী হিসেবে নির্ণয় করা হয়। এরপর তাকে নিয়মিত ট্রমা-ফোকাসড সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়। চিকিৎসার উদ্দেশ্য ছিল তার সত্তাগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করা এবং ধীরে ধীরে তাদের একত্রিত করার চেষ্টা করা। ব্যবহার করা হয় গ্রাউন্ডিং টেকনিকস, রিল্যাক্সেশন থেরাপি এবং ইন্টিগ্রেশন ফোকাসড কাউন্সেলিং। এক বছরেরও বেশি সময় নিয়মিত থেরাপির পর, সাবিনা ধীরে ধীরে তার আলাদা সত্তাগুলোর উপস্থিতি বুঝতে শেখেন এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার পথে এগিয়ে যান।
সাবিনার গল্প আমাদের শেখায় যে, DID কোনো সিনেমার গল্প নয়, এটি গভীর মানসিক আঘাতের বাস্তব প্রতিফলন। আমাদের সমাজে এখনো এই রোগ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। আক্রান্তদের “অস্বাভাবিক” বা “উন্মাদ” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অথচ এই সমস্যাটি মানসিক নির্যাতনের পরিণতিতে গড়ে ওঠা এক জটিল প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা, যা পেশাদার সহায়তা ও সহানুভূতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
সাবিনার মতো অনেকেই আমাদের চারপাশে আছেন—নীরবে নিজেদের ভেতরে এক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের কর্তব্য শুধু জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং হৃদয় দিয়ে বোঝা এবং পাশে দাঁড়ানো। যদি আপনি মনে করেন, আপনার নিজের বা পরিচিত কারো মধ্যে DID-এর মতো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তবে দেরি না করে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সচেতনতা, সহানুভূতি এবং সময়মতো সঠিক সহায়তাই হতে পারে উত্তরণের চাবিকাঠি।