অভির অদৃশ্য লড়াই: ক্লেপ্টোম্যানিয়া এক মানসিক ব্যাধি

- আপডেট সময় : ০৮:৪১:২৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ মে ২০২৫ ২১৯ বার পড়া হয়েছে
ড. মো: মাহিদ শেখ ,সাইকোলজিস্ট ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ: রাজশাহীর একটি কলেজে পড়ুয়া ১৭ বছর বয়সী অভি (ছদ্মনাম) আচমকা এমন এক অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ে, যা তার পরিবার ও শিক্ষকদের গভীর উদ্বেগে ফেলে দেয়। বিগত ছয় মাস ধরে অভি বিভিন্ন সময় বন্ধুবান্ধব, লাইব্রেরি কিংবা দোকান থেকে ছোট ছোট জিনিস—যেমন কলম, রাবার, চকলেট—চুরি করে আসছিল। এসব জিনিস তার প্রয়োজন ছিল না এবং সেগুলো সে কখনোই ব্যবহার করত না।
প্রতিবার চুরির পর সে অপরাধবোধে ভুগত, নিজেকে দোষী ভাবত এবং প্রতিজ্ঞা করত—‘আর কখনো না’। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই অজানা তাড়নায় সে একই আচরণে ফিরে যেত।
ক্লেপ্টোম্যানিয়া: একটি অজানা মানসিক ব্যাধি: পরিবার প্রথমে বিষয়টিকে কিশোর বয়সের দুষ্টুমি বলে মনে করলেও, ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে তারা একজন মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের পর চিকিৎসক জানান, অভি ক্লেপ্টোম্যানিয়া নামক মানসিক সমস্যায় ভুগছে। ক্লেপ্টোম্যানিয়া এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় ও তুচ্ছ জিনিস চুরি করে, যদিও তার কোনও ব্যক্তিগত লাভ বা চাহিদা থাকে না। এটি কোনো লোভ বা প্রতিশোধমূলক কাজ নয়, বরং এক ধরনের অদমনীয় মানসিক তাড়নার বহিঃপ্রকাশ।
লক্ষণসমূহ: ক্লেপ্টোম্যানিয়ার ভুক্তভোগীরা সাধারণত এমন আচরণে লিপ্ত হন যা তাদের নিজেদেরও অযাচিত মনে হয়। তারা প্রয়োজন ছাড়াই বারবার ছোটখাটো জিনিস চুরি করে ফেলেন। চুরির আগে তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ বা অস্থিরতা তৈরি হয়, এবং চুরির সময় তারা সাময়িক স্বস্তি ও প্রশান্তি অনুভব করেন। তবে এসব চুরির পেছনে কোনো বাহ্যিক প্ররোচনা, অভাব বা ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্য থাকে না। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো—চুরি করার পর তারা গভীর অপরাধবোধে ভোগেন, তবুও এই আচরণ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারেন না।
ক্লেপ্টোম্যানিয়ার প্রভাব: এই মানসিক সমস্যাটি কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একজনের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ক্লেপ্টোম্যানিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি বারবার চুরির মতো সমাজবিরোধী আচরণে জড়িয়ে পড়ায় আইনি জটিলতা ও গ্রেপ্তারের আশঙ্কা তৈরি হয়। এর ফলে ব্যক্তি আত্মসম্মানহানী ও আত্মবিশ্বাসের সংকটে ভোগেন। এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয় এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। দীর্ঘদিন এই অবস্থায় থাকলে মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ ও একাকীত্ব বেড়ে গিয়ে অবস্থা আরও জটিল হতে পারে।
করণীয় ও চিকিৎসা: বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্লেপ্টোম্যানিয়া একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক সমস্যা, যা সঠিক চিকিৎসা ও সহানুভূতিশীল সহায়তার মাধ্যমে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি, বিশেষ করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT), অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে, কারণ এটি ব্যক্তির চিন্তাভাবনার ধরণ ও আচরণগত প্রতিক্রিয়া পরিবর্তনে সহায়তা করে। কিছু ক্ষেত্রে মানসিক চাপে ভারসাম্য আনতে SSRI জাতীয় ওষুধও ব্যবহার করা হয়। তবে শুধুমাত্র চিকিৎসা নয়, পরিবারের সদস্য ও সমাজের পক্ষ থেকেও বোঝাপড়া ও সহানুভূতির মনোভাব রাখা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি স্কুল, পরিবার ও সামাজিক পরিসরে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ এই সমস্যাকে মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন: ক্লেপ্টোম্যানিয়া কোনো চরিত্রগত দুর্বলতা নয়, এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। সমাজে এই বিষয়টি নিয়ে এখনো অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। দোষারোপ নয়, বরং সহানুভূতিশীল আচরণ ও সময়মতো চিকিৎসাই একজন মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। প্রিয়জনের মধ্যে যদি এমন আচরণ লক্ষ্য করেন, দয়া করে তাকে গোপন রাখবেন না। একজন পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করুন। সঠিক সহায়তা, ভালোবাসা ও সচেতনতা—এই তিনটিই পারে কাউকে নতুন করে শুরু করার সুযোগ করে দিতে।