ঢাকা ০৫:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভুল যেন পিছুই ছাড়ছে না নতুন পাঠ্যবইয়ে, সংঙ্কায় শিক্ষা ব্যবস্থা

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৫:২০:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ১১৭ বার পড়া হয়েছে

নিউজ ডেস্ক:


‘পাঠ্যবইয়ে ভুল’ যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও পাঠ্যবইয়ে শতাধিক ভুল পেয়েছেন তারা। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সাইট বা ব্লগ থেকে কপি করার প্রবণতা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) মার্চ মাসে ভুল যাচাই করে সংশোধন দেওয়ার কথা জানিয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বইয়ে ভুলের বিষয়ে লেখক ও সম্পাদককে দায় নিতে হবে। পাশাপাশি বই লেখা ও সম্পাদনায় আরও সতর্ক থাকতে হবে।

গত বছর থেকে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই যায়। চলতি বছর গেছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এসব বইয়ের মধ্যে বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ে ভুলের পরিমাণ বেশি।

যেসব ভুল পাওয়া গেছে: বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতি অনুসরণের কথা বলা হলেও অনেক বানানেই সেই নীতি অনুসরণ করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই ণত্ববিধান ও ষত্ববিধানের নিয়ম মানা হয়নি। মাধ্যমিক স্তরের বাংলা বইয়ে লেখক ও কবি পরিচিতি দেওয়া হয়েছে একেবারে সংক্ষিপ্ত আকারে। এ ছাড়া মলাটে এক শ্রেণি এবং ভেতরে অন্য শ্রেণির বই লেখা হয়েছে বলেও অভিযোগ এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নবম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের দশম পৃষ্ঠায় নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র ও তার ব্যাখ্যায় গাড়ির ত্বরণের মান ভুল দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় তরলের ভেতরে চাপের ধারণা দিতে গিয়ে পারদের জন্য চাপের মান ভুল দেওয়া হয়েছে। ৩২ পৃষ্ঠায় অনুর গতি ও তাপমাত্রা অংশে সেলসিয়াস, কেলভিন ও ফারেনহাইটের মধ্যে তাপমাত্রার যে সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, তা ভুল। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় কঠিন পদার্থের প্রসারণ অংশে ক্ষেত্রফলের পরিবর্তন হিসেবে যে মান দেখানো হয়েছে, তা-ও ভুল। ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় ক্যালরিমিতি অংশে কাচের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার যে প্রয়োজনীয় তাপ দেখানো হয়েছে, সেটিও ভুল।

এই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে হাট লেখা হলেও তৃতীয় লাইনে (ঁ) যোগ করে হাঁট লেখা হয়েছে। ২৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে এ দেশটির স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে লক্ষ্য মানুষের আত্মদান। এখানে লক্ষ্য এর জায়গায় হবে লক্ষ বা লাখো। ২৮ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদে লড়াইয়ের না লিখে লেখা হয়েছে লড়ায়ের। ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ভাষণগুলোতে না লিখে লেখা হয়েছে ভাষণগুলোর। একই পৃষ্ঠায় লক্ষ্যকে লক্ষ লেখা হয়েছে। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় র‌্যাডক্লিফকে লেখা হয়েছে র‌্যাডাক্লিফ। ৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের গঠনকাল লেখা হয়েছে ১৯৬০ সাল। মূলত এটির গঠন নিয়ে দুটি সালের তথ্য পাওয়া যায়।

এগুলো হলো ১৯৬১ ও ১৯৬২ সাল। ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা লাভের পর যে সময়কালের ঘটনা বর্ণনা হয়েছে, সেখানে বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি হিসেবে লেখা হয়েছে। তিনি কী ছিলেন, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। ৫৪ নম্বর পৃষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণকে লেখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ্য। একই পৃষ্ঠায় সাম্রাজ্যের-কে সাম্রাজ্যর এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রান্জ ফার্দিনান্দকে লেখা হয়েছে যুবরাজ ফারডিনাগু। ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠায় সংবাদ সম্মেলনকে লেখা হয়েছে সাংবাদ সম্মেলন। ৫৮-৬০ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ অনুচ্ছেদের সঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়ার ‘বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ’ অংশের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। ১০০তম পৃষ্ঠায় সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই- এটি মধ্যযুগের কবির লেখা উল্লেখ করা হলেও সেই কবি বড়ু চণ্ডীদাসের নাম উল্লেখ নেই।

এই শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের ভূমিকায় সহযোগিতাকে ‘সহযোগীতা’ লেখা হয়েছে। ‘পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’—বাক্যটি ১৫ বার ব্যবহার করা হলেও ১৩ বারই ‘পৃখিবী’ লেখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানিক, পাকিস্তানকে লেখা হয়েছে পকিস্তান। ণত্ববিধান ও ষত্ববিধান না মেনে ‘ভাতখণ্ড’কে লেখা হয়েছে ‘ভাতখন্ড’। এই শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের ২৬ পৃষ্ঠায় বাংলা কবিতা থাকলেও ঠিক তার পরেই ইংরেজি কিছু নতুন শব্দের অবতারণা হয়েছে।

অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খানের মৃত্যুসাল দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে জন্ম-মৃত্যু (১৯২৯-১৯৮২) লেখা হলেও পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ লেখা হয়েছে। তিনি মূলত ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এই বইয়ের ২৬ নম্বর পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি নম্বর চাওয়া হয়েছে। যদিও এখনো শিক্ষার্থীরা ইউনিক আইডি কার্ড ও নম্বর পায়নি। ৪০তম পৃষ্ঠায় ষষ্ঠকে লেখা হয়েছে ‘ষষ্ট’।

৫৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘ত্রয়োদশ০০ সাল’। ৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় কিলোমিটারকে লেখা হয়েছে ‘কীলোমিটার’। ১০৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ৩০ লাখ শিশু শ্রমিকের কথা বলা হয়েছে। যদিও গত বছরের জুলাই মাসের হালনাগাদ অনুযায়ী দেশে শিশু শ্রমিক ৩৫ লাখ। ১২১ নম্বর পৃষ্ঠায় চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বাম পাশে তার শিল্পকর্ম মোনালিসার অবস্থান লেখা হয়েছে, এটি হবে ডান পাশে। ১৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝুঁকিকে ‘ঝুঁকী’ লেখা হয়েছে। ১৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝুঁকিপূর্ণকে লেখা হয়েছে ‘ঝুঁকীপূর্ণ’।

একই শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে সুস্থ বানান লেখা হয়েছে ‘সুস্থ্য’। এ ছাড়া বাক্য গঠনেও অনেক ভুল ও অসংগতি ধরা পড়েছে। বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ফিল্ড ট্রিপ অধ্যায়ে (৬৪ পৃষ্ঠা) খরগোশ ও কচ্ছপের গল্পের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতার যে গাণিতিক সমাধান চাওয়া হয়েছে, সেটিকে ভুল বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মত হলো, এক ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার প্রতিযোগিতার জন্য যে আদিবেগ ও ত্বরণের মান দেওয়া হয়েছে, তাতে খরগোশ ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার যেতে পারবে। গত বছর ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠ বইয়ের ‘চাঁদ সূর্যের পালা’ অধ্যায়ে অভিশপ্ত চাঁদ বাদ দিয়ে ‘চাঁদের গল্প’ নাম দেওয়ার সুপারিশ করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। কিন্তু এ বছরও সেটি একই রাখা হয়েছে।

মাদ্রাসা স্তরের ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম ও দশম শ্রেণির ‘কাওয়াইদুল লুগাতুল আরাবিয়্যাহ’ বইয়ের মলাটে এসব শ্রেণির আরবি নামের ক্ষেত্রে ব্যাকরণগত ভুল করা হয়েছে। যেমন সপ্তম শ্রেণির আরবি নামে লেখা হয়েছে ‘আসসাফফু’। শব্দের শেষ বর্ণে পেশ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী শব্দের শেষ বর্ণে ব্যবহার করা হয়েছে যের।

আরবি ব্যাকরণের নিয়ম হলো, প্রথম শব্দের শেষ বর্ণে পেশ হলে পরের শব্দের শেষ বর্ণেও পেশ এবং প্রথম শব্দের শেষ বর্ণে যের হলে পরের শব্দের শেষ বর্ণেও যের দিতে হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, এটি মারাত্মক ভুল। এতে আরবি ব্যাকরণ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।

এদিকে অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১০৪ নম্বর পৃষ্ঠায় নারীরা এখন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী ও শ্রমমন্ত্রী বলা হয়েছে। বইটি গত বছর যখন লেখা হয়েছে, তখনকার সময়ের জন্য ভুল না হলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় রদবদলের কারণে তথ্যটি এখন আর সঠিক নয়। দীপু মনির জায়গায় এখন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন মুহিবুল হাসান চৌধুরী আর গত মেয়াদে বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শ্রম প্রতিমন্ত্রী থাকলেও এবার মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন। স্কুলগুলোতে এ তথ্য সংশোধনী আকারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম।

অষ্টম ও নবম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে আপত্তিকর অধ্যায়

অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে ‘কৈশোরের কথামালা’ অধ্যায়ে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনের এবং নবম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ‘আপন আলোয় আলোকিত হই’ অধ্যায়ে যৌন সম্পর্ক, শারীরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় এসেছে। শিক্ষাবিদরা শিক্ষার্থীদের শারীরিক পরিবর্তনের এ বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোকে স্বাগত জানালেও যে ভাষায় তা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।

বইয়ে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব নেই, ইসরায়েলের ভুল মানচিত্র

নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ‘মিলেমিশে নিরাপদে বসবাস’ নামক অধ্যায়ের ১৪৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘নগর বসতি’ শিরোনামের পাঠে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জেরিকা, জুড়িয়া, ইসরায়েল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া, মিশর, জর্ডান নামক স্থানের অবস্থান দেখানো হয়েছে। বইটিতে দাবি করা হচ্ছে, এ মানচিত্রটি প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান নির্দেশ করছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই বইয়ে প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান সংবলিত যে মানচিত্রটি দেখানো হয়েছে, তা সঠিক নয়; বরং জেরিকো নগরীর অবস্থান নির্দেশ করতে গিয়ে মানচিত্রে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়কালের স্থানকে নির্দেশ করা হয়েছে। তা ছাড়া মানচিত্রে গাম্বিয়া নামে যে স্থানটিকে নির্দেশ করা হয়েছে, সেখানে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া নয়, রয়েছে ফিলিস্তিনের গাজার অবস্থান। নগর-বসতির পরিচয় দিতে গিয়ে মানচিত্রে ফিলিস্তিনকে ইসরায়েল উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই মানচিত্রে জুডিয়া ও সামারা নামে যে দুটি জায়গার পরিচয় দেওয়া হয়েছে, এ নাম সাধারণত ইসরায়েল ব্যবহার করে থাকে। মুসলিম বিশ্বে এ দুটো এলাকা পশ্চিম তীর নামে পরিচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, এটি দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। যারা বইটি লেখেন, তারা বাচ্চাদের স্বার্থ না দেখে অনেক সময় ইচ্ছেমতো লিখে দেন। সম্পাদনা যারা করেন, তাদেরও বিষয়টি যত্নের সঙ্গে দেখা উচিত। নইলে বাচ্চারা ভুল শেখবে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নাদিম মাহমুদের মতে, নবম শ্রেণির অনুসন্ধানী পাঠ বইটির অনেক বিষয় আংশিক বা হুবহু নেওয়া হয়েছে মিশরভিত্তিক সফটওয়্যার কোম্পানি প্রাক্সিল্যাবস ডটকমের ব্লগ, ভারতীয় কোচিং সেন্টার বাইজুস (Byju’s)-এর ওয়েবসাইটসহ অন্যান্য উৎস থেকে। বইটির ইংরেজি সংস্করণ (ভার্সন) তৈরিতেও ‘গুগল ট্রান্সলেটর’ ব্যবহৃত হয়েছে। বইটির সিংহভাগ চিত্রের কনসেপ্ট ইন্টারনেট থেকে হুবহু নিয়ে পুনঃচিত্রায়ণ করে বইটিতে ছাপানো হয়েছে। এ ছাড়া ভুল রাসায়নিক সংকেতও ব্যবহার করা হয়েছে। রয়েছে তথ্যগত ভুলও।

নাদিম মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, গত বছরের মতো একই কায়দায় চুরি করে শিশুদের জন্য পাঠ্যবই তৈরি করা হয়েছে। গাইড বই তুলে দাও, কোচিং সেন্টার বন্ধ করো—কথাগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েক বছর ধরে বলার চেষ্টা করছে; কিন্তু তারা যখন পাঠ্যপুস্তক লিখছে, সেখানে কোচিং সেন্টারের ম্যাটেরিয়ালস, ব্লগ সরাসরি ঢুকে পড়ছে। তিনি বলেন, যে বইটি কোটি কোটি শিশু বছরের পর বছর ধরে পড়বে, সেই বই লেখা হয়েছে অবহেলা আর অবজ্ঞার মধ্য দিয়ে, যা সত্যিই বেদনাদায়ক।

নবম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইটির রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে কথা বলে গুরুত্ব বাড়ানোর কিছু নেই।

এর আগে গত বছর নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করার অভিযোগ সত্য বলে দায় স্বীকার করে নেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।

একই লেখককে দিয়ে অনেক বই লেখানোর ফলে ভুল বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, প্রতিবছর পাঠ্যবইয়ে ভুল দেখতে পাচ্ছি। উদ্ভট বাক্য গঠনসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে কপি করার কথাও শুনতে পাচ্ছি। যারা সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন, তারা ঠিকমতো কাজ করলে বারবার ভুলের বিষয়টি আসত না। তিনি বলেন, পাঠ্যবইয়ে ভুলের দায় বইয়ের লেখক, সম্পাদক ও এনসিটিবিকে নিতে হবে। যারা খুব ব্যস্ত, তাদের অনেক বই লেখা বা সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়। এতে তার ওপর চাপ পড়ে। এজন্য একই লেখককে দিয়ে সব বই না লিখিয়ে কয়েকজন লেখককে যুক্ত করা যেতে পারে।

এদিকে নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রণীত পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুলভ্রান্তি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে দ্রুত তা সংশোধনের আশ্বাস জানানো হয়েছে এনসিটিবির পক্ষ থেকে। এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের সব মতামত একত্র করে যাচাই-পূর্বক এর সংশোধনী দেওয়া হবে। সময়স্বল্পতার কারণে ভুলগুলো হতে পারে। মার্চের শুরুতে এসব সংশোধনী যেতে পারে।


প্রসঙ্গনিউজ২৪/জে.সি

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

ভুল যেন পিছুই ছাড়ছে না নতুন পাঠ্যবইয়ে, সংঙ্কায় শিক্ষা ব্যবস্থা

আপডেট সময় : ০৫:২০:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

নিউজ ডেস্ক:


‘পাঠ্যবইয়ে ভুল’ যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও পাঠ্যবইয়ে শতাধিক ভুল পেয়েছেন তারা। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সাইট বা ব্লগ থেকে কপি করার প্রবণতা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) মার্চ মাসে ভুল যাচাই করে সংশোধন দেওয়ার কথা জানিয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বইয়ে ভুলের বিষয়ে লেখক ও সম্পাদককে দায় নিতে হবে। পাশাপাশি বই লেখা ও সম্পাদনায় আরও সতর্ক থাকতে হবে।

গত বছর থেকে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই যায়। চলতি বছর গেছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এসব বইয়ের মধ্যে বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের বইয়ে ভুলের পরিমাণ বেশি।

যেসব ভুল পাওয়া গেছে: বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির বাংলা বানান রীতি অনুসরণের কথা বলা হলেও অনেক বানানেই সেই নীতি অনুসরণ করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই ণত্ববিধান ও ষত্ববিধানের নিয়ম মানা হয়নি। মাধ্যমিক স্তরের বাংলা বইয়ে লেখক ও কবি পরিচিতি দেওয়া হয়েছে একেবারে সংক্ষিপ্ত আকারে। এ ছাড়া মলাটে এক শ্রেণি এবং ভেতরে অন্য শ্রেণির বই লেখা হয়েছে বলেও অভিযোগ এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নবম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইয়ের দশম পৃষ্ঠায় নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র ও তার ব্যাখ্যায় গাড়ির ত্বরণের মান ভুল দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় তরলের ভেতরে চাপের ধারণা দিতে গিয়ে পারদের জন্য চাপের মান ভুল দেওয়া হয়েছে। ৩২ পৃষ্ঠায় অনুর গতি ও তাপমাত্রা অংশে সেলসিয়াস, কেলভিন ও ফারেনহাইটের মধ্যে তাপমাত্রার যে সম্পর্ক দেখানো হয়েছে, তা ভুল। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় কঠিন পদার্থের প্রসারণ অংশে ক্ষেত্রফলের পরিবর্তন হিসেবে যে মান দেখানো হয়েছে, তা-ও ভুল। ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় ক্যালরিমিতি অংশে কাচের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার যে প্রয়োজনীয় তাপ দেখানো হয়েছে, সেটিও ভুল।

এই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে হাট লেখা হলেও তৃতীয় লাইনে (ঁ) যোগ করে হাঁট লেখা হয়েছে। ২৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে এ দেশটির স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে লক্ষ্য মানুষের আত্মদান। এখানে লক্ষ্য এর জায়গায় হবে লক্ষ বা লাখো। ২৮ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদে লড়াইয়ের না লিখে লেখা হয়েছে লড়ায়ের। ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ভাষণগুলোতে না লিখে লেখা হয়েছে ভাষণগুলোর। একই পৃষ্ঠায় লক্ষ্যকে লক্ষ লেখা হয়েছে। ৩৬ নম্বর পৃষ্ঠায় র‌্যাডক্লিফকে লেখা হয়েছে র‌্যাডাক্লিফ। ৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের গঠনকাল লেখা হয়েছে ১৯৬০ সাল। মূলত এটির গঠন নিয়ে দুটি সালের তথ্য পাওয়া যায়।

এগুলো হলো ১৯৬১ ও ১৯৬২ সাল। ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বাধীনতা লাভের পর যে সময়কালের ঘটনা বর্ণনা হয়েছে, সেখানে বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি হিসেবে লেখা হয়েছে। তিনি কী ছিলেন, তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। ৫৪ নম্বর পৃষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণকে লেখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ্য। একই পৃষ্ঠায় সাম্রাজ্যের-কে সাম্রাজ্যর এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রান্জ ফার্দিনান্দকে লেখা হয়েছে যুবরাজ ফারডিনাগু। ৫৯ নম্বর পৃষ্ঠায় সংবাদ সম্মেলনকে লেখা হয়েছে সাংবাদ সম্মেলন। ৫৮-৬০ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ অনুচ্ছেদের সঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়ার ‘বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ’ অংশের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। ১০০তম পৃষ্ঠায় সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই- এটি মধ্যযুগের কবির লেখা উল্লেখ করা হলেও সেই কবি বড়ু চণ্ডীদাসের নাম উল্লেখ নেই।

এই শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের ভূমিকায় সহযোগিতাকে ‘সহযোগীতা’ লেখা হয়েছে। ‘পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’—বাক্যটি ১৫ বার ব্যবহার করা হলেও ১৩ বারই ‘পৃখিবী’ লেখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিকের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানিক, পাকিস্তানকে লেখা হয়েছে পকিস্তান। ণত্ববিধান ও ষত্ববিধান না মেনে ‘ভাতখণ্ড’কে লেখা হয়েছে ‘ভাতখন্ড’। এই শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের ২৬ পৃষ্ঠায় বাংলা কবিতা থাকলেও ঠিক তার পরেই ইংরেজি কিছু নতুন শব্দের অবতারণা হয়েছে।

অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খানের মৃত্যুসাল দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে জন্ম-মৃত্যু (১৯২৯-১৯৮২) লেখা হলেও পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ লেখা হয়েছে। তিনি মূলত ১৯৮২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এই বইয়ের ২৬ নম্বর পৃষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি নম্বর চাওয়া হয়েছে। যদিও এখনো শিক্ষার্থীরা ইউনিক আইডি কার্ড ও নম্বর পায়নি। ৪০তম পৃষ্ঠায় ষষ্ঠকে লেখা হয়েছে ‘ষষ্ট’।

৫৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘ত্রয়োদশ০০ সাল’। ৮২ নম্বর পৃষ্ঠায় কিলোমিটারকে লেখা হয়েছে ‘কীলোমিটার’। ১০৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ৩০ লাখ শিশু শ্রমিকের কথা বলা হয়েছে। যদিও গত বছরের জুলাই মাসের হালনাগাদ অনুযায়ী দেশে শিশু শ্রমিক ৩৫ লাখ। ১২১ নম্বর পৃষ্ঠায় চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বাম পাশে তার শিল্পকর্ম মোনালিসার অবস্থান লেখা হয়েছে, এটি হবে ডান পাশে। ১৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝুঁকিকে ‘ঝুঁকী’ লেখা হয়েছে। ১৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ঝুঁকিপূর্ণকে লেখা হয়েছে ‘ঝুঁকীপূর্ণ’।

একই শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে সুস্থ বানান লেখা হয়েছে ‘সুস্থ্য’। এ ছাড়া বাক্য গঠনেও অনেক ভুল ও অসংগতি ধরা পড়েছে। বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ফিল্ড ট্রিপ অধ্যায়ে (৬৪ পৃষ্ঠা) খরগোশ ও কচ্ছপের গল্পের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতার যে গাণিতিক সমাধান চাওয়া হয়েছে, সেটিকে ভুল বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মত হলো, এক ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার প্রতিযোগিতার জন্য যে আদিবেগ ও ত্বরণের মান দেওয়া হয়েছে, তাতে খরগোশ ঘণ্টায় ১৩ কিলোমিটার যেতে পারবে। গত বছর ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠ বইয়ের ‘চাঁদ সূর্যের পালা’ অধ্যায়ে অভিশপ্ত চাঁদ বাদ দিয়ে ‘চাঁদের গল্প’ নাম দেওয়ার সুপারিশ করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। কিন্তু এ বছরও সেটি একই রাখা হয়েছে।

মাদ্রাসা স্তরের ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম ও দশম শ্রেণির ‘কাওয়াইদুল লুগাতুল আরাবিয়্যাহ’ বইয়ের মলাটে এসব শ্রেণির আরবি নামের ক্ষেত্রে ব্যাকরণগত ভুল করা হয়েছে। যেমন সপ্তম শ্রেণির আরবি নামে লেখা হয়েছে ‘আসসাফফু’। শব্দের শেষ বর্ণে পেশ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী শব্দের শেষ বর্ণে ব্যবহার করা হয়েছে যের।

আরবি ব্যাকরণের নিয়ম হলো, প্রথম শব্দের শেষ বর্ণে পেশ হলে পরের শব্দের শেষ বর্ণেও পেশ এবং প্রথম শব্দের শেষ বর্ণে যের হলে পরের শব্দের শেষ বর্ণেও যের দিতে হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, এটি মারাত্মক ভুল। এতে আরবি ব্যাকরণ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।

এদিকে অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১০৪ নম্বর পৃষ্ঠায় নারীরা এখন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী ও শ্রমমন্ত্রী বলা হয়েছে। বইটি গত বছর যখন লেখা হয়েছে, তখনকার সময়ের জন্য ভুল না হলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় রদবদলের কারণে তথ্যটি এখন আর সঠিক নয়। দীপু মনির জায়গায় এখন শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন মুহিবুল হাসান চৌধুরী আর গত মেয়াদে বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শ্রম প্রতিমন্ত্রী থাকলেও এবার মন্ত্রণালয়টির দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন। স্কুলগুলোতে এ তথ্য সংশোধনী আকারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম।

অষ্টম ও নবম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে আপত্তিকর অধ্যায়

অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে ‘কৈশোরের কথামালা’ অধ্যায়ে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনের এবং নবম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ‘আপন আলোয় আলোকিত হই’ অধ্যায়ে যৌন সম্পর্ক, শারীরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় এসেছে। শিক্ষাবিদরা শিক্ষার্থীদের শারীরিক পরিবর্তনের এ বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোকে স্বাগত জানালেও যে ভাষায় তা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।

বইয়ে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব নেই, ইসরায়েলের ভুল মানচিত্র

নবম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের ‘মিলেমিশে নিরাপদে বসবাস’ নামক অধ্যায়ের ১৪৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘নগর বসতি’ শিরোনামের পাঠে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে লেবানন, সিরিয়া, সামারা, জেরিকা, জুড়িয়া, ইসরায়েল, জেরুজালেম, গাম্বিয়া, মিশর, জর্ডান নামক স্থানের অবস্থান দেখানো হয়েছে। বইটিতে দাবি করা হচ্ছে, এ মানচিত্রটি প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান নির্দেশ করছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই বইয়ে প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান সংবলিত যে মানচিত্রটি দেখানো হয়েছে, তা সঠিক নয়; বরং জেরিকো নগরীর অবস্থান নির্দেশ করতে গিয়ে মানচিত্রে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়কালের স্থানকে নির্দেশ করা হয়েছে। তা ছাড়া মানচিত্রে গাম্বিয়া নামে যে স্থানটিকে নির্দেশ করা হয়েছে, সেখানে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া নয়, রয়েছে ফিলিস্তিনের গাজার অবস্থান। নগর-বসতির পরিচয় দিতে গিয়ে মানচিত্রে ফিলিস্তিনকে ইসরায়েল উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই মানচিত্রে জুডিয়া ও সামারা নামে যে দুটি জায়গার পরিচয় দেওয়া হয়েছে, এ নাম সাধারণত ইসরায়েল ব্যবহার করে থাকে। মুসলিম বিশ্বে এ দুটো এলাকা পশ্চিম তীর নামে পরিচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, এটি দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। যারা বইটি লেখেন, তারা বাচ্চাদের স্বার্থ না দেখে অনেক সময় ইচ্ছেমতো লিখে দেন। সম্পাদনা যারা করেন, তাদেরও বিষয়টি যত্নের সঙ্গে দেখা উচিত। নইলে বাচ্চারা ভুল শেখবে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নাদিম মাহমুদের মতে, নবম শ্রেণির অনুসন্ধানী পাঠ বইটির অনেক বিষয় আংশিক বা হুবহু নেওয়া হয়েছে মিশরভিত্তিক সফটওয়্যার কোম্পানি প্রাক্সিল্যাবস ডটকমের ব্লগ, ভারতীয় কোচিং সেন্টার বাইজুস (Byju’s)-এর ওয়েবসাইটসহ অন্যান্য উৎস থেকে। বইটির ইংরেজি সংস্করণ (ভার্সন) তৈরিতেও ‘গুগল ট্রান্সলেটর’ ব্যবহৃত হয়েছে। বইটির সিংহভাগ চিত্রের কনসেপ্ট ইন্টারনেট থেকে হুবহু নিয়ে পুনঃচিত্রায়ণ করে বইটিতে ছাপানো হয়েছে। এ ছাড়া ভুল রাসায়নিক সংকেতও ব্যবহার করা হয়েছে। রয়েছে তথ্যগত ভুলও।

নাদিম মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, গত বছরের মতো একই কায়দায় চুরি করে শিশুদের জন্য পাঠ্যবই তৈরি করা হয়েছে। গাইড বই তুলে দাও, কোচিং সেন্টার বন্ধ করো—কথাগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েক বছর ধরে বলার চেষ্টা করছে; কিন্তু তারা যখন পাঠ্যপুস্তক লিখছে, সেখানে কোচিং সেন্টারের ম্যাটেরিয়ালস, ব্লগ সরাসরি ঢুকে পড়ছে। তিনি বলেন, যে বইটি কোটি কোটি শিশু বছরের পর বছর ধরে পড়বে, সেই বই লেখা হয়েছে অবহেলা আর অবজ্ঞার মধ্য দিয়ে, যা সত্যিই বেদনাদায়ক।

নবম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ বইটির রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে কথা বলে গুরুত্ব বাড়ানোর কিছু নেই।

এর আগে গত বছর নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করার অভিযোগ সত্য বলে দায় স্বীকার করে নেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।

একই লেখককে দিয়ে অনেক বই লেখানোর ফলে ভুল বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, প্রতিবছর পাঠ্যবইয়ে ভুল দেখতে পাচ্ছি। উদ্ভট বাক্য গঠনসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে কপি করার কথাও শুনতে পাচ্ছি। যারা সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন, তারা ঠিকমতো কাজ করলে বারবার ভুলের বিষয়টি আসত না। তিনি বলেন, পাঠ্যবইয়ে ভুলের দায় বইয়ের লেখক, সম্পাদক ও এনসিটিবিকে নিতে হবে। যারা খুব ব্যস্ত, তাদের অনেক বই লেখা বা সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়। এতে তার ওপর চাপ পড়ে। এজন্য একই লেখককে দিয়ে সব বই না লিখিয়ে কয়েকজন লেখককে যুক্ত করা যেতে পারে।

এদিকে নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রণীত পাঠ্যবইয়ে থাকা ভুলভ্রান্তি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতামত যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে দ্রুত তা সংশোধনের আশ্বাস জানানো হয়েছে এনসিটিবির পক্ষ থেকে। এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের সব মতামত একত্র করে যাচাই-পূর্বক এর সংশোধনী দেওয়া হবে। সময়স্বল্পতার কারণে ভুলগুলো হতে পারে। মার্চের শুরুতে এসব সংশোধনী যেতে পারে।


প্রসঙ্গনিউজ২৪/জে.সি